চর্যাপদ : বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম নিদর্শন
চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম পদ সংকলন। ভারতীয় আর্য ভাষার ও প্রাচীনতর রচনা এটি। খ্রিস্টীয় ৬৫০-১২০০ (ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে )বা ৯৫০-১২০০ সালের মধ্যে (আচার্য সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় এর মতে ) রচিত এই গীতিপদাবলীর রচয়িতা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের রহসমূলক অর্থ সাংস্কৃতিক রূপের আশ্রয় ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তারা পদগুলো রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাত ও হয়েছিল এই চর্যাপদ থেকেই।
সে বিবেচনায় এটি একটি ধর্মগ্রন্থ জাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলী এই পদগুলোতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ এখনও চিত্তাকর্ষক। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামোহপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী , নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষনের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনিস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন। চর্যাপদের প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ , কানহুপাদ , ভুসুকুপাদ , শবরপাদ প্রমুখ।
চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি না সে বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীকালে যার অবসান হয়েছে। এটি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতিতে পারদর্শী হলেও তারা তৎকালীন অপরিনিত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যবধি আবিষ্কৃত আদিমতম রূপ। এই ভাষা সাম্প্রদায়বিশেষের সাধন সঙ্গীতের ভাষা বিধায় অস্পষ্ট ও দুবোধ্য যদিও এতে উল্লেখিত ছন্দ ও রাগ রাগিনী পরবর্তীকালে বাঙলী কবিদের পথনির্দেশিকা রূপে কাজ করে। তবে প্রাচীন কবিদের মতে এটিতে সন্ধ্যা বা আলোআঁধারী ভাষা ব্যবহার করা হয় সেই সাথে গদ্য ছন্দ ব্যাবহৃত হয়।
চর্যার পদগুলো প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী রচিত। এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও দেখা যায়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যাবহারই এখানে বেশি। তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারিতি দেখা যায়নি। চর্যার অনুপ্রাসের প্রয়োগ ব্যাপক। প্ৰায় প্রতিটি পদই অন্তমিলযুক্ত। চর্যার উল্লেখিত ছন্দ ও অলংকারগুলি পরবর্তীকালের কবিদের পথপ্রদর্শকস্বরূপ হয়েছিল।
চর্যাগীতিতে ব্যাবহারিত উপমা ও রূপকগুলি তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন , পরিবারজীবন ও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে সংগৃহিত। প্রসঙ্গত মনে রাখা প্রয়োজন , সেই যুগে বাংলার ভৌগোলিক সীমা আজকের পরচিমবঙ্গ বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরেও পূর্বে অসম ও পশ্চিমে বিহার , ঝাড়খন্ড ও পূর্ব উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তিত ছিল। তৎকালীন বাংলার ভূগোল ও সমাজ সম্পর্কে যে ছবি চর্যাপদ থেকে পাওয়া যায় , তা সেই সময়কার বাঙলীর ইতিহাস রচনায় একটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
চর্যাপদের যুগে নারীরা খুব স্বাধীন ছিলেন বলে জানা যায়। তারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী সঙ্গী ও পেশা নির্বাচনের অধিকার রাখতেন। কুক্করিপা গৃহবধূর ছল করা নিয়ে বলেছেন , " সে দিনের বেলায় কাকের ডাকে ভয় পায় , কিন্তু রাতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যায়। " এছাড়াও সেসময়ে নারীরা গুরুর স্থান ও অধিকার করেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ