বাংলা সালতানাত: সুলতানি আমলে বাংলার সাহিত্য - সাংস্কৃতি

বাংলা সালতানাত: সুলতানি আমলে বাংলার সাহিত্য - সাংস্কৃতি  



বাংলা সালতানাত: সুলতানি আমলে বাংলার সাহিত্য - সাংস্কৃতি








স্বাধীন সুলতানি আমলে এদেশে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ যে ওই কালের কীর্তিনিচয়ের অন্যতম, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ওই সময় এদেশের মানুষ বিভিন্ন কারণে বাংলা, সংস্কৃত, আরবী, ফারসী- এই চারটি ভাষা ব্যবহার করত।



 জনসাধারণ তখনকার চলিত বাংলা ব্যবহার করত বটে, কিন্তু সংস্কৃত ভাষা বঙ্গে মুসলমান আগমনের পূর্ব থেকে রাজভাষা ও হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা হওয়ার কারণে জনসাধারণের মধ্যেই এর একটি বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের কথায়, মুসলিম আমলে সংস্কৃত রাজভাষার মর্যাদা হারাইল বটে, তবু হিন্দু সংস্কৃতি ও জীবনধারার সহিত পরিচিত হইবার জন্য অনেক মুসলমানও সংস্কৃত শিখতেন।



 বাস্তবিকই সংস্কৃত ভাষার প্রতি মুসলমানদের কোন বিদ্বেষ ছিল না। ইহা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপারও নহে; জাতি যখন বড় হয়, তখন সে ওপরের সমস্ত জ্ঞান, তাহা পৃথিবীর যে ভাষাতেই থাকুক, আহরণ করিয়া জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করে থাকেন। উঠন্ত জাতি হিসাবে বাঙালি মুসলমানেরাও এই নীতির অনুসরণ করিয়াছিলেন, যদিও সহনশীল মুসলিম আদর্শ ও সংস্কৃতি হইতেই তাহারা অধিক পরিমানে প্রেরণা লাভ করিতেন। 







স্বাধীনতার যুগে, এমন কি তুর্কী আমলেও বাংলার মুসলমান যে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলন করিতেন, তাহার প্রমান ব্যাপক। বাংলার তুর্কী আমল হইতে স্বাধীনতার শেষ যুগ পর্যন্ত বাংলাদেশে যত মুসলিম শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহার ভাষা আগাগোঁড়াই আরবী। 




মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবী বলিয়া, জাতীয় সংস্কৃতির মূল বাহক ও ধারক হিসাবে এই ভাষার সহিত সোজাসুজি পরিচয় স্থাপন করা মুসলমানেরা নিশ্চয় শ্রেষ্ঠ ভাষাগত কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেন। কেননা, তাহারা জানিতেন- বিদ্যার্জন করা বিদ্যাঅর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যই কর্তব্য। বাঙালি মুসলমানের দেশীয় সাহিত্য রচনায় এই আরবী চর্চার প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। 





বাংলা ভাষায় যে সমস্ত আরবী শব্দ প্রবেশ করিয়াছে, তাহা শুধু আদালতে ব্যবহৃত ফারসি ভাষার মধ্যস্থতায় ঘটে নাই, ইহা বাংলায় ব্যাপকভাবে আরবী ভাষা চর্চারও ফল। বাঙালি মুসলমানেরা এই স্বাধীনতার যুগে বাংলা ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যও সৃষ্টি করিয়াছেন। এই সাহিত্য আরবী ভাষার সহিত সোজাসুজি সংযোক স্থাপনেই সম্ভবপর হইয়াছিল। 








ফারসী চিরদিনই মুসলমান আমলে সরকারী ভাষা ছিল। ফারসী স্বাধীন বঙ্গে ব্যাপকভাবে হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা অনুশীলিত হইত। সরকারী ভাষার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল বলিয়া অনেকেই বাধ্য হইয়া এই ভাষা শিখিত। আবার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ভাষা হিসাবেও অনেকেই ইহার অনুশীলন করিত। 





এই সময়ে ফারসী ভাষা ও সাহিত্য এবং মুসলমানদের পোশাক-পরিচ্ছদ কিভাবে বাংলার হিন্দুদের মধ্যে বহুল প্রচলিত হয়, তাহার কিছু কিছু উদাহরণ জয়ানন্দের 'চৈতন্য মঙ্গলে' দেখিতে পাওয়া যায়। জগাই-মাধাই নামক যে দুইজন বৈষ্ণবদ্রোহী হিন্দুকে চৈতন্যদের বৈষ্ণবমতে দীক্ষিত করেন, তাহাদের সম্বন্ধে জয়ানন্দ বলেনঃ 

                                    'মসনবি আবৃতি করে থাকে নলবনে। 

                                    মহাপাপী জগাই মাধই দুই জনে।'  


কলিকালের অর্থাৎ চৈতন্যদেবের সম-সময়ের হিন্দু সমাজের বিদ্যা, আচার-ব্যবহার প্রভৃতির বর্ণনা প্রসঙ্গেও জয়ানন্দ লিখেছেনঃ 

                                    'ব্রাক্ষণে রাখিবে দাড়ি পারস্য পড়িবে। 

                                    মোজা পাত্র নডি হাতে কামান ধরিবে।।

                                   মনসবি আবৃত্তি করিবে দ্বিজবর। 

                                   ডাকা-চুরি ঘাঁটি সাধিবেক নিরন্তর।।'  



ব্রাক্ষণগন মুসলমানের ন্যায় দাড়ি রাখতে শুরু করিয়াছেন, সংস্কৃত ছাড়িয়া ফারসী ভাষা পারিতেছেন, তাহারা মোজা পরিধান করিয়া এক হাতে যষ্ঠি ও অন্য হাতে কামান বা ধনুক ধারণ করিতেছেন, এবং মুখে মুখে পারস্যের সুফী কবি মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির (১২০৭-১২৭৩) মসনবী গ্রন্থ আবৃতি করিতেছেন , ইহাই তো তখনকার দিনের হিন্দু সমাজের অবস্থা। 








এমনি পরিবেশ ফারসী সাহিত্যের নানা প্রভাব যে হিন্দু-মুসলমানের বাংলা সাহিত্যে পরবে, তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। এই প্রভাব প্রধানতঃ শব্দ, বিষয়, ভাব ও অনুবাদ এই চার প্রকারেই বাংলাকে সমৃদ্ধি করেছে। এতদসঙ্গে সে সময়ে এদেশে ইসলাম  বিস্তৃতির কোথাও ভাবতে হয়। স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকেই দেশে ইসলাম বিস্তৃত হতে থাকলেও তার পরিধি ছিল বেশ কিছুটা সঙ্কীর্ণ।





 দেশের রাষ্ট্রীয় সীমা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম বিস্তৃতির সীমাও বর্ধিত হতে থাকে। একদিকে মুসলিম সেনাপতি ও সৈন্যেরা রাজ্যের পর রাজ্য জয় করিয়াছেন, অন্যদিকে ঔলিয়া, দরবেশ ও আলিমগণ দলে দলে ইসলাম প্রচার করিয়াছেন। এই সময়ে দেশে যে সমস্ত দরবেশ ও আলিম প্রচার কার্য চালাইয়াছিলেন, তাদের মধ্যে গৌড়ের আখী সিরাজুদ্দীন (মৃত ১৩৫৭), পাণ্ডুয়ার শেখ আলাউল হক (মৃত- ১৩৯৮), নূর কুৎব-ই-আলম (মৃত-১৪১৬), হুগলির ফুরফুরার শাহ আনওয়ার কুলী হলবী (মৃত- ১৩৭৫), রংপুরের শাহ ইসমাইল গাজী (হত্যা- ১৪৭৪), খুলনার খানজাহান (মৃত-১৪৫৮), সোনার গায়ের হাজী বাবা সালিহ (মৃত- ১৫০৬) , সহ  আরো অনেকে। 




এমনি করেই সারা দেশ সুফী দরবেশ ও আলিমদের প্রচার তৎপরতায় ভরে উঠেছিল। দেশের সর্বত্র এখনও মুসলিম শাসকদের শত শত আরবী শিলালিপি ছড়িয়ে রয়েছে। এসব শিলালিপি থেকে মুসলিম শাসকদের যে মানস-চিত্র ফুটে ওঠে, তা কোন বিজয়ীর নিরেট ভয়াবহ চিত্র নয়, তা ইসলামের প্রেমের চিত্র, ভ্রাতৃত্বের ছবি, প্রীতির বিশ্ব-বিজয়নি রূপ। ইসলাম যেন স্বীয় প্রাণের বিরাটত্ব, জ্ঞানের ঐশ্বর্য, সভ্যতার সম্পদ, সংস্কৃতির বিভব বাংলায় দুই হাতে বিলিয়ে দিয়েছে, আর বাংলার এতদিনকার ধর্মীয় সামাজিক অভিশাপে জর্জর নরনারী তা কুড়িয়ে নিয়ে নিজেদেরকে কৃতার্থ মনে করছে !





ইসলামের এই মহাপ্রাণটাই স্বাধীন সুলতানি আমলে বাংলার হিন্দুকে স্বেচ্ছায় ইসলাম কবুল করতে উৎসাহিত করে। ফলে, বাংলায় অনেক বৃদ্ধি পায় মুসলমানের সংখ্যা। এ  সময়ে বাংলার মুসলমানেরা দেশি ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের এবং ইসলামী সংস্কৃতির সমৃদ্ধি সম্পাদনে আত্ননিয়োগ করতে থাকেন। 





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ