চণ্ডীদাস : বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সাধক

 চণ্ডীদাস : বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সাধক 




চণ্ডীদাস : বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সাধক








চণ্ডীদাস (১৩৭০-১৪৩০),মধ্যযুগের চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি। তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। চৈতন্যের জন্মের আগে থেকেই চণ্ডীদাসের নামোল্লেখিত বহু গীতিপদ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চৈতন্য নিজে তার পদ আস্বাদন করতেন। শ্রুতি আছে ,রজকিনী রামী তার সহজসাধনের সঙ্গিনী ছিলেন। 











বাংলাদেশের মাগুরা জেলা সদর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে শালিখা উপজেলার শতখালি ইউনিয়নের শতখালি গ্রামের ধোপাখালী পাড়া তে জন্ম নেন চণ্ডীদাস। 



বাংলা ভাষায় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কিত প্রায় ১২৫০ টির অধিক কাব্যের সন্ধান পাওয়া গেছে যেখানে রচয়িতা হিসেবে বড়ু চণ্ডীদাস ,দীন চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস তিনটি ভিন্ন নামের উল্লেখ রয়েছে আবার কোনোটিতে রচয়িতার নামের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় নি। এ কাব্যগুলো ভণিতা  নামে পরিচিত। ভণিতা  একই ব্যক্তি কতৃক রচিত কিনা তা পরিষ্কার করে জানা যায় না। আধুনিক পণ্ডিতরা ধারণা করে থাকেন ,বর্তমান যে সকল কবিতা চণ্ডীদাসের নামে রয়েছে তা অন্তত চারজন ভিন্ন চণ্ডীদাস কর্তৃক রচিত হয়েছে। ভণিতা কাব্যের রচনাশৈলী অনুযায়ী তাদের পৃথক করা যায়। 







প্রথম চণ্ডীদাস হিসেবে পদাবলীর চণ্ডীদাসকে ধারণা করা হয় যিনি আনুমানিক ১৪ শতকে বীরভূম জেলায় (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ )জন্ম নেন ;তিনি চৈতন্য-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী রচয়িতা হিসেবে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। 




কারও কারও মতে ,তিনিই মধ্যযুগীয় বাংলা কবিতার অন্যতম নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন। তবে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমানের সাহায্যে প্রমান করেছেন , 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন 'রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। 




এই কাব্যে কবি নিজেকে অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস হিসেবে ভণিতা দিয়েছেন। তার আসল নাম অনন্ত ,কৌলিক উপাধি বড়ু ,এবং গুরুপ্রদত্ত নাম চণ্ডীদাস। তিনি বাসলী /বাশুলী দেবীর উপাসক ছিলেন। ''বড়ু ''শব্দটি "বটু "বা "বাঁড়ুজ্যে"(বন্দোপাধ্যায় )শব্দের অপভ্ৰংশ বলে মনে করা হয়। 





চণ্ডীদাসের মৃত্যু সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ স্থানীয় প্রবাদের উল্লেখ করেছেন -বীরভূমের নানুরে বাশুলীদেবীর মন্দিরের কাছে চণ্ডীদাস কীর্তন দলের একটি নাট্যশালা ছিল। 


চণ্ডীদাস একবার গৌড়ের নবাবের রাজসভায় গান গাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করতে সেখানে যান। তার কণ্ঠে ভক্তি-প্রেমের গান শুনে নবাবের বেগম মুগ্ধ হয়ে যান এবং তিনি চণ্ডীদাসের গুনের অনুরাগী হয়ে পড়েন। বেগম একথা নবাবের কাছে স্বীকার করলে নবাব ক্রোধের বশে চণ্ডীদাসকে মৃত্যুর দণ্ডাদেশ দেন। আত্মীয় বন্ধুবর্গের সামনে চণ্ডীদাস হস্তিপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে নিদারুণ কশাঘাত সহ্য করে প্রাণ বিসর্জন দেন ;বেগম সেই দৃশ্য দেখে শোকে মূর্চ্ছিতা হয়ে প্রাণবিয়োগ করেন। 



কথিত আছে ,শূদ্র কন্যা রামীর সঙ্গে তার প্রেম ছিল বলে স্থানীয় লোকজন তাকে মেরে তার বাড়িতে চাপা দিয়ে দেয়। আবার কারও মতে তিনি সেই সময়ের বৈষ্ণব পীঠস্থান ইলামবাজারে পালিয়ে গিয়েছিলেন। 

দীন চণ্ডীদাস এবং দ্বিজ চণ্ডীদাস নামক ভণিতার দুইজন কবিকে চৈতন্য -পরবর্তী যুগের কবি বলে ধারণা করা হয়। তবে এই নামদুটি ভণিতার হেরফের মাত্র বলেই অনুমিত হয়। 






বড়ু চণ্ডীদাস :

'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তার আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তার প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তার তিনটি ভনিতা পাওয়া যায়-'বড়ুচণ্ডীদাস ' ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে এবং 'চণ্ডীদাস ' ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার। ৭টি পদে ব্যবহৃত 'আনন্ত 'শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়। ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন ,চণ্ডীদাস তার নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তার কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দোপাধ্যায়ের অপভ্ৰংশ। 




কবি চৈতন্যপূর্বকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলীর চণ্ডীদাস কে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন ,ড.মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমানের সাহায্যে প্রমান করেছেন ,'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন 'রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া জেলার সদর মহকুমাস্থ ছাতনার অধিবাসী ছিলেন। 





বড়ুচণ্ডীদাস বাসলী দেবীর উপাসক ছিলেন এবং দেবীমন্দিরের নিকটবর্তী স্থানে তার 'চিত্রনাট্যগীতি 'পরিবেশনের নাট্যশালা ছিল। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী চন্ডী অথবা মনসার অপর নাম। সম্ভবত বাসলী  দেবীর বাৎসরিক পূজায় গীত হওয়ার উদ্দেশ্যে দেবীর স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে কবি কর্তৃক এই কাব্য রচিত হয়েছিল। 


পদাবলী :

সহজিয়া ভাবধারায় পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস রচিত মানবিক প্রেমের কয়েকটি পদ-


"ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া আছয়ে যে জন ,কেহ না জানয়ে তারে। 

প্রেমের আরতি যে জন জানয়ে সেই সে চিনিতে পারে।।"

''মরম না জানে ,মরম বাথানে ,এমন আছয়ে যারা। 

কাজ নাই সখি ,তাদের কথায় ,বাহিরে রহুন তারা। 

আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে -ভিতর দুয়ার খোলা। ''



''কহে চণ্ডীদাস ,কানুর পিরীতি -জাতিকুলশীল ছাড়া। ''

''প্রণয় করিয়া ভাঙ্গয়ে যে। সাধন -অঙ্গ পায় না সে। ''



''কি লাগিয়া ডাকরে বাঁশি আর কিবা চাও। 

বাকি আছে প্রাণ আমার তাহা লৈয়া যাও। ''



সহজিয়া গুরুবাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি লেখেন ,

''শুনহ মানুষ ভাই,সবার উপরে মানুষ বড় ,তাহার উপরে নাই। ''












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ